বর্তমান সমাজে শুধু পুরুষ আয় করবে আর নারী সংসার সামলাবে, এ ধারণা নিয়ে চললে অনেক সংসারেই দিন শেষে চুলায় হাঁড়ি উঠবে না। এ কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের চাকরি-বাকরি করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আয় নিয়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন ধরনের দাম্পত্য কলহ। সমস্যাটা আসলে আপনার কর্মজীবী স্বামী বা স্ত্রীর নয়, সিস্টেমের।
আয় কম বা বেশি হওয়ায় ঈর্ষা, আয় করেন না বলে স্ত্রীর সিদ্ধান্তে প্রাধান্য না দেওয়া, অথবা পরিবারের কোন খাতে খরচ হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব- এসবের নিদর্শন প্রচুর। আয় নারীর বেশী হোক বা পুরুষের, তা নিয়ে কলহ লেগেই যায়। এমন মনোমালিন্যের সমাধান একটাই, তা হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া। মানুষের আয় কমতে পারে, বাড়তে পারে, এমনকি শূন্যও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরবে কেন?
সম্প্রতি দ্যা গার্ডিয়ানে বিষয়টি নিয়ে চমৎকার একটি প্রতিবেদন উঠে এসেছে। আর্থিক বিষয়ে যেন মনোমালিন্য না হয়, সে জন্য বিভিন্ন দম্পতি বিভিন্ন পন্থা বের করে নিয়েছেন নিজেদের মাঝে আলোচনা করে। এটাও দেখা গেছে যে, আসলে কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রীয় কিছু নীতির কারণেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আয়ের বৈষম্য তৈরি হয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আয় কম-বেশি হলে একটি উপায় অনেককে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তা হলো- দু’জনের আয়কে একত্রিত করা, এবং সে অনুযায়ী খরচ করা।
ক্যানবেরার বাসিন্দা দুই সন্তানের মা অ্যানা তার স্বামীর তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশী আয় করেন। কিন্তু সংসারে ভারসাম্য বজায় রাখতে তারা একটি জয়েন্ট একাউন্টে উভয়ের বেতন জমা করেন। শুধু তাই নয়, প্রতি ১৫ দিন পরপর তারা একই পরিমাণ অর্থ ওই একাউন্ট থেকে তোলেন। ফলে কে বেশি ব্যয় করছেন, কোথায় কী খরচ করছেন, এ নিয়ে তাদের মাঝে কোনো অতিরিক্ত জবাবদিহির প্রয়োজন হয় না।
নর্থ সাউথ ওয়েলসের এক নারী জানান, সাবেক স্বামীর তুলনায় তার বেতন বরাবরই বেশী ছিল। এতে তার সাবেক স্বামী ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে বিশাল অংকের অর্থ খুইয়ে বসেন ওই নারী। তিনি আবারও নতুন করে সংসার করতে যাচ্ছেন। তবে এবার তিনি কিছু নিয়ম ঠিক করেছেন যেমন- সংসারে যে কোনো খরচেই তার মতামতের প্রাধান্য থাকবে, উপহার হিসেবে টাকা দেওয়া হলে সেটারও হিসাব রাখতে হবে এবং একে অপরকে কখনোই টাকা ধার দেবেন না।
পার্থ এলাকার বাসিন্দা ড্যানিয়েল জানান, স্ত্রীর তুলনায় তার আয় অনেক কম। তিনি সারা বছরে যা আয় করেন, তার স্ত্রী সে পরিমাণ টাকা শুধু আয়কর দিতেই ব্যয় করেন। প্রথম প্রথম এই আয় বৈষম্যে কিছুটা অসন্তোষ থাকলেও এখন তা সয়ে গেছে বলে জানান ড্যানিয়েল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তার স্ত্রী কয়েক বছর আগে অসুস্থতার কারণে চাকরি করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সরকারি নীতি অনুযায়ী, যেহেতু তিনি বিবাহিত এবং এই দম্পতির আয় সপ্তাহে ১৮০০ ডলারের বেশি, ওই নারী বৃদ্ধ বয়সে প্রতিবন্ধী হিসেবে অবসর ভাতা পাবেন না। এ সমস্যা সমাধানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি নিজের আয় থেকেই তার স্ত্রীর জন্য কিছু টাকা নিয়মিত জমা করে রাখেন। এছাড়া সাংসারিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার জন্য তিনি স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এ পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অস্ট্রেলিয়ার ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি বলেন, আসলে বৈষম্যটা আসে কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রীয় নীতি থেকেই। বেতন নিয়ে অসন্তোষ অনেক ক্ষেত্রে পরিবার পর্যন্ত গড়ায়। তার স্ত্রী ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু তার বেতন এতই কম যে, তাদের ২৩ বছর বয়সী ছেলে সন্তানও তার থেকে বেশী আয় করেন। সমস্যাটা যেহেতু পরিবারের বাইরে থেকে আসছে। তাই এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়াটা অনুচিত।
ফোর্বসের সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় গড়ে ১৬ শতাংশ কম আয় করেন। নারী ও পুরুষের আয় কম বেশি হয় পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই। কিন্তু বেতন সমান দেওয়াই কী সমাধান? তা কিন্তু নয়।
হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদরা ১৫ বছরব্যপী একটি গবেষণা করেন। এতে দেখা যায়, পুরুষ ও নারীর ঘণ্টাপ্রতি কাজ ও বেতনের পরিমাণ একই হওয়া সত্ত্বেও নারীরা কিছু কম আয় করছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষরা ওভারটাইম কাজ করতে বেশি আগ্রহী থাকেন। ছুটির দিনে, রাতে কাজ করার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশী থাকে। অন্যদিকে নারীরা ওভারটাইম না করে নিজের পরিবারের প্রতি সময় বেশি দিতে আগ্রহী থাকেন।
সন্তান আছে, এমন কর্মীদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য চোখে লাগার মতো। পুরুষরা সন্তানের খরচ যোগাতে বেশি বেশি ওভারটাইম করে টাকা রোজগার করতে আগ্রহী হন। অন্যদিকে নারীরা সন্তানকে সময় দেওয়ার জন্য ওভারটাইম করা বাদ দিয়ে দেন।
ওভারটাইমে কাজ করার জন্য ঘণ্টাপ্রতি বেতন প্রায় দেড়গুণ। পুরুষরা বেশি ওভারটাইম করেন বলে তাদের আয় শেষ মেষ নারীদের তুলনায় বেশি হয়।
আরেকটা ব্যাপার হলো, সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার লালন পালনের জন্য এক-দুই বছর নারীদের ক্যারিয়ারে ছেদ পড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র এক বছর ক্যারিয়ারে ছেদ পড়ার কারণে নারীদের বাৎসরিক আয় কমে যেতে পারে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত। এ পটভূমি পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
হার্ভার্ডের এ গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। বলা হয়, লম্বা শিফটে কাজ করাটাকে প্রাধান্য দেয় বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্র। কিন্তু তা না করে ছোট ছোট শিফটে কাজ করানো হলে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে পুরুষের সমান কাজ করতে পারতো। সংসার সামলে ওভারটাইম করা যাবে না, রাত্রে কাজ করা যাবে না, এসব বাধা তখন আর থাকতো না।
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে- একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রের নীতির কারণে নারীরা আর্থিকভাবে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারছেন না, তেমনি পুরুষ খরচ দেবে আর নারী সংসারে বেশ সময় দেবে, এই সামাজিক ধারণাটাও নারীর আয় কম হওয়ার জন্য দায়ী।