প্রায় ৭৪ হাজার পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থমালা; এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। খণ্ড দুই শতাধিক; আটশর বেশি লেখকের নির্বাচিত রচনায় সমৃদ্ধ। সংকলনটির নাম ‘বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ’। গত ২০০ বছরে শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তকদের যেসব রচনা জাতির মানসভুবনকে ঋদ্ধ করেছে, বৈচিত্র্যে ও গভীরতায় উজ্জ্বল সেসব অমূল্য রচনাকে এক সুতায় গেঁথেই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই গ্রন্থমালা।
এর শুরু ২৪ বছর আগে। যে প্রতিষ্ঠানটির স্লোগান ‘আলোকিত মানুষ চাই’, সেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বপ্নের প্রকল্প এটি। স্বপ্নচারী এ মানুষটির পরিকল্পনাতেই ২০০০ সালে এ প্রকল্পের বীজ রোপিত হয়েছিল। এতদিনে তা পুষ্পশোভিত, প্রকাশউন্মুখ হয়ে উঠেছে। সংকলনটি প্রকাশের সূচনা হতে যাচ্ছে কাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রধান মিলনায়তনে।
আয়োজকরা জানাচ্ছেন, এ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৬টি বিষয়– ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, পরিবেশ, চলচ্চিত্র, সংগীত, রাজনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি, নারী, সমাজ ও শিক্ষা। প্রতিটি বিষয়ের গ্রন্থের নামকরণ হয়েছে এভাবে– ‘বাঙালির ইতিহাসচিন্তা’, ‘বাঙালির দর্শনচিন্তা’ প্রভৃতি। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-গবেষকসহ যে কোনো অনুসন্ধিৎসু জ্ঞানার্থীর জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে সংকলনটি। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠকরা বাঙালি জাতির ঐশ্বর্যময় মননভান্ডারের পরিচয় পাবেন। পাঠক যেমন সমগ্র সংকলনটির সব খণ্ড একত্রে কিনতে পারবেন, তেমনি নিজের প্রয়োজন বা পছন্দ অনুযায়ী এক বা একাধিক বিষয়ের যে কোনো সংখ্যক খণ্ড পারবেন সংগ্রহ করতে।
পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি বিষয়ের প্রথম খণ্ডে মুদ্রিত ‘সম্পাদকের কথা’য় খণ্ডগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এবং প্রথম খণ্ডের শেষে লেখক ও বিষয় অনুযায়ী বর্ণানুক্রমিক সূচি রয়েছে। পুরো গ্রন্থমালার সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এ ছাড়া প্রতিটি বিষয়ের এক বা একাধিক সম্পাদক রয়েছেন। অধিকাংশ প্রবন্ধই ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সংগৃহীত। পরেও কিছু লেখা সংযোজিত হয়েছে। লেখাগুলো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পাওয়া। প্রকল্পটির জন্য একটি ওয়েবসাইটও (bcrsbskbd.org) করা হয়েছে। যেখানে পাঠক প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি খণ্ডের সারসংক্ষেপ, মূল্য, সম্পাদকদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। অনলাইনে বই কেনার সুবিধাও থাকছে এখানে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্বপ্ন দেখেন, দেখান, বাস্তবায়ন করেন। তাঁর পরিকল্পনায় প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। আজ এই রচনা সংগ্রহ প্রকাশের পালা। ইতোমধ্যে পাঁচটি বিষয়ের (সংস্কৃতি, দর্শন, নারী, বিজ্ঞান ও ইতিহাস) চুয়ান্নটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে বাকি খণ্ডগুলো প্রকাশিত হবে।’
প্রকল্পটির সম্পাদকীয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন কবি জাফর আহমদ রাশেদ। তাঁর ভাষ্য– ‘এমন একটি প্রকল্পের কল্পনা বা পরিকল্পনা করাই বিস্ময়কর। বাস্তবায়ন করা আরও বড় চ্যালেঞ্জের। সেটাই করে দেখিয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গত ২০০ বছরে শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তকদের রচনা নিয়ে এ সংকলন হলেও এর পরিধি, ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও ব্যাপক। যেমন ধরা যাক দর্শন চিন্তার কথা। বাঙালি মনীষীরা শুধু নিজস্ব দর্শন চিন্তার বিষয়টিই তুলে ধরেননি, আলোচনা করেছেন পৃথিবীর প্রাচীন দার্শনিকদের মতবাদ নিয়েও। একই সঙ্গে এসব রচনায় মিশে আছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শন। এভাবে ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, পরিবেশসহ প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে কালের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি প্রযোজ্য।’ যে কোনো সংকলনেরই সীমাবদ্ধতা থাকে। এটিরও আছে। সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলমান থাকবে পরিমার্জন, পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে নতুন সংস্করণের মাধ্যমে বলে যোগ করেন তিনি।
এ প্রকল্পের চিন্তা কীভাবে শুরু হলো তারই স্মৃতিচারণ করছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সালের কোনো এক সকাল। ঘুম থেকে উঠে চিন্তাটা মাথায় এলো। উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণের পর থেকে ২০০ বছরজুড়ে বাঙালির বৌদ্ধিক সমৃদ্ধির যে সময়কাল, সেটিকে কী করে ধরে রাখা যায়। কেননা চিন্তা, মূল্যবোধ, মননশীলতা, জ্ঞানচর্চা, মুক্তিসংগ্রাম– সব মিলিয়ে বাঙালির জীবনে এ সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, উর্বর ও ঐশ্বর্যময়। এ সময়ে বহু বাঙালি মনীষী, ভাবুক বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করেছেন, লিখেছেন। তাদের সেই রচনাগুলোকে একত্র করতে পারলে তা বাঙালি জাতির জন্য বিরাট সম্পদে পরিণত হবে।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আরও জানান, তাঁর নেতৃত্বে ২০০০ সালে ডেঙ্গুবিরোধী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলছিল। একদিন বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (বর্তমানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক) এ অভিযানে আর্থিক সহযোগিতা করতে চাইলেন। তবে তিনি ড. ইফতেখারুজ্জামানকে জানান, এ অভিযানে আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। এ সময় তিনি বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহের বিষয়টি তাঁকে জানালেন। ইফতেখারুজ্জামান এ প্রকল্পে অর্থায়নে রাজি হয়ে গেলেন। পরে প্রাইম ব্যাংকও এর সঙ্গে যুক্ত হলো। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘এর পরই লেখা সংগ্রহ ও নির্বাচনের কাজ শুরু হলো। কয়েকজন অধ্যাপক ও সাংবাদিকের সঙ্গে লেখাগুলো নিয়ে চলল আলোচনা, আড্ডা, পাঠচক্র। প্রতি শনিবারে বসতাম। এতে নিজেরাও উপকৃত হলাম। এভাবেই খেলতে খেলতে, শিখতে শিখতে প্রকল্পটি দাঁড়িয়ে গেল। আমাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না; তবে আন্তরিকতা ছিল। এতদিনে সংকলনটি প্রকাশিত হচ্ছে, ভালো লাগছে। এ থেকে দেশবাসী উপকৃত হলে আরও ভালো লাগবে।’